অফিশিয়ালি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধে পদক্ষেপ নিবেন বলে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মারও ইউক্রেনের ওপর নিরবচ্ছিন্ন রুশ হামলার বিরোধিতা করে আসছেন শুরু থেকেই। একইভাবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, ইতালিয়ান প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি কিংবা জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসও ইউক্রেনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলমান রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছেন।
২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই তাঁরা আলোচনা, সংলাপ বা সমঝোতার মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনের প্রতি জোরালোভাবে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। তবে অবিশ্বাস্যভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মজলুম জনপদ ফিলিস্তিনে দশকের পর দশক ধরে অব্যাহত থাকা অবৈধ বর্বরোচিত ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে তাঁরা টুঁ-শব্দটিও পর্যন্ত করেননি। উল্টো হামলাকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বুলি আওড়ে কিংবা মৌন সমর্থন জারি রেখে গণহত্যাকারীদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন পশ্চিমারা।
তাহলে কি আমরা বলতে পারি, পশ্চিমাদের শান্তির বাণী, মানবতার জয়গান, নারীমুক্তির শ্লোক ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার বাইরেই শুধু সীমাবদ্ধ? নাকি গাজা কিংবা ফিলিস্তিনের নারী-শিশু এবং আবালবৃদ্ধবনিতারা মানুষ নন? অথচ পশ্চিমা পরিবেশবাদীরা তো নির্বিচার পশু-পাখি এবং বৃক্ষ হত্যার বিরুদ্ধেও অ্যাকটিভিজম পরিচালনা করে থাকেন। আর সেখানে জলজ্যান্ত একটা জনপদকে নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারাকে কেন তাঁরা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন?
অবশ্য সাধারণ মানুষ কীভাবে এসবের বিরোধিতা করবেন— সেটাও ভাববার বিষয়। কেননা বিরোধিতা করতে গেলেই তো ২০২৪ সালের এপ্রিলে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা অঙ্গরাজ্যের ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ক্যারলিন ফলিনকে মাটিতে ফেলে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরা হয়েছিল, তেমনিভাবে যে কাউকে চেপে ধরবেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। এই হলো বিশ্বজুড়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার পক্ষে সাফাই গেয়ে বেড়ানো দেশগুলোর অবস্থা!
তবুও যে প্রকৃত মানবতাবাদীরা একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে আছেন, বিষয়টা তেমন নয়। খোদ ইসরায়েলেই বহু মানুষ দেশটির যুদ্ধবাজ উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে এসেছিলেন গত বছরের জুলাইয়ে। তাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁদের সকল কপটতার বিরুদ্ধে। কিন্তু খুব বেশি লাভ হয়নি এতে। কারণ “জোর যার, মুল্লুক তার”— এ কথাটা ক্ষমতাসীনদের জন্য অক্ষরে অক্ষরে সত্য। বিশেষ করে যখন তাঁদের পেছনে মদদ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সহযোগীরা সর্বদা সক্রিয় রয়েছেন।
অপর দিকে, মধ্যপ্রাচ্যের বাঘা বাঘা রাষ্ট্রনায়কেরাও নিজেদেরকে অর্থসম্পদ আর আভিজাত্যের মায়াজালে বন্দী করে ফেলেছেন। ফলে পশ্চিমা মদদপুষ্ট ইসরায়েলি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কড়া ভাষা উচ্চারণ করার ক্ষেত্রে তাদের মেরুদণ্ডের দৃঢ়তা আর চোখে পড়ে না। দুনিয়ায় পাবলিক সেন্টিমেন্ট বলে যদি একটা প্রসঙ্গ না থাকতো, তবে নামকাওয়াস্তে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানানোর বদলে ইসরায়েল এবং তার মিত্রদের সঙ্গে থাকা মাখো মাখো সম্পর্ককে তাঁরা আরও উঁচুতে নিয়ে যেতেই কাজ করতো বলে মনে করেন অনেকে।
এরপরও আরব রাষ্ট্র মিশর, কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় নেওয়া বাইডেন প্রশাসনের চাপে গত ১৯ জানুয়ারি ১৭ মাস ধরে গাজায় চলমান বর্বরতা ক্ষণিকের জন্য বন্ধ হয়। যদিও ইতিমধ্যে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখ লাখ অধিবাসী।
কিন্তু যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার দুই মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৭ মার্চ মধ্যরাতে আবার অতর্কিত হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী। এতে করে চোখের পলকে ঝরে গেছে চার শতাধিক প্রাণ। এর মধ্যে শিশু রয়েছেন ১৩০ জনের কিছু কম-বেশি। আছেন গাজার ডি-ফ্যাক্টো প্রধানমন্ত্রী ইসাম দা’আলিসসহ শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন হামাস নেতাও। হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট স্বয়ং গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করেই ইসরায়েল এ হামলা চালিয়েছে।
এভাবে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ইসরায়েল বারবার হামলা চালানোর নজির স্থাপন করলেও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দেশটির বিরুদ্ধে তেমন শোরগোল তোলেনি কোনো রাষ্ট্র। কারণ বরাবরের মতোই ট্রাম্পদের ন্যায় মার্কিন প্রেসিডেন্টরা প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পক্ষ অবলম্বন করলেও বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার সক্ষমতা কারই-বা আছে? এর চেয়ে মৌনতা অবলম্বন করে নিজেদের মসনদ টিকিয়ে রেখে অর্থ আর আভিজাত্যের মাঝে দিনাতিপাত করাই শ্রেয়!
অবশ্য ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়ে দলটির সদস্যদের এভাবে বোকা বানানোর ঘটনা এটাই প্রথম নয় ইসরায়েলের জন্য। এর আগেও বহুবার যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করার বেশ কয়েকদিনের মাথায় সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে টার্গেট করে হামলা করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ইসরায়েল। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলেন ইসাম দা’আলিসরা।
ইতিমধ্যে কট্টরপন্থী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গত বছর আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে তাঁর সমর্থনকারী মার্কিন বা অন্যান্য পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের বিষয়ে কিন্তু কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। অথচ নেতানিয়াহু যদি মানবতাবিরোধী অপরাধ কিংবা যুদ্ধাপরাধ করে থাকেন, তবে বাইডেন আর ট্রাম্প প্রশাসনও এর দায় এড়াতে পারে না ইসরায়েলের প্রতি অন্ধ সমর্থনের কারণে।
সম্প্রতি যে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ইসরায়েল গাজায় আবার হামলা চালিয়েছে এর জন্য নেতানিয়াহুর পাশাপাশি তার পরামর্শদাতা হিসেবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও মামলা করা যেতে পারে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা যেমন দুঃসাহসিক কাজ, তেমনি জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যগুলোর ভেটোপ্রদানের ক্ষমতা থাকায় তাঁরা তা ব্যবহার করে সহজেই আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসবে।
ফলে সার্বিকভাবে নিজেদের স্বার্থে পশ্চিমারা এভাবেই একপাক্ষিক মানবতা, নারীমুক্তি এবং শান্তির গান গেয়ে যাবে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গকে অগ্রাহ্য করে। এবং এই গান গাওয়ার অভিনয়ের ক্ষেত্রে ৪-৫ বছর পর পর কিছু কিছু জায়গায় অভিনেতা বদল হলেও অটুট থেকে যাবে ছলনার চিরায়ত ধারা। অটুট রয়ে যাবে জায়নবাদ বনাম প্রকৃত মানবতাবাদের মধ্যকার সংগ্রাম!
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
ইমেইল: rusaidahmed02@gmail.com
খুলনা গেজেট/এনএম